স্বাধীনতার পর ঢাকার আয়তন বাড়লেও নতুন কোনো পার্ক নির্মাণ হয়নি

ঢাকায় বড় বড় উদ্যান-পার্কের প্রায় সবই স্বাধীনতার আগেকার। স্বাধীনতার পর নগরীর আয়তন বাড়লেও নতুন কোনো পার্ক নির্মাণ হয়নি। প্রায় ৬৯ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ঢাকা শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা পার্ক বা রমনা উদ্যান মোগল সেনাপতি ইসলাম খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬১০ সালে।
ব্রিটিশ আমলে এক কালেক্টরের হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যদিও নামকরণ হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর । ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর হাত ধরে ১৯০৯ সালে স্থাপিত হয়েছিল ঢাকার ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত বলধা গার্ডেন । উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নওয়াব স্যার আব্দুল গণির উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক বর্তমানে যেটি বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত।
ঢাকা ও আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার ভূমি ব্যবহার, আবাসন, পরিবহন, পানি নিষ্কাশন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, সামাজিক ও নাগরিক সেবা ইত্যাদি প্রদানের জন্য একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে ড্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে।২০১৬-৩৫ সাল পর্যন্ত প্রস্তাবিত খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় নগরবাসীর অবসর বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ৬২টি পার্ক তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এসব পার্ক থেকে রাজস্ব আয়েরও পরিকল্পনা রয়েছে রাজউকের। পরিকল্পিত এসব পার্ক নগরজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ধীরে ধীরে প্রাত্যহিক জীবনযাপনেরও অংশ হয়ে ওঠার পাশাপাশি এসব পার্ককে ঘিরে অনেক অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড্যাপভুক্ত এলাকাকে ছয়টি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ড্যাপে প্রতিটি অঞ্চলে কমপক্ষে একটি করে আঞ্চলিক মাপের পার্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে একটি করে আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমােন শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চলেই আঞ্চলিক মাপের পার্ক রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যোন রয়েছে।
গোড়ান চটবাড়ী, গাবতলী ও উত্তরখান রিটেনশন পন্ড এলাকা, শিয়ালবাড়ী ও কালশী মাটিকাটা রাস্তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে ওয়াটার পার্ক ও অন্যান্য ধরনের পার্ক গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। গাজীপুর অঞ্চলে অবস্থিত ভাওয়াল বনাঞ্চলকে ঘিরে ইকোপার্কের আদলে নতুন একটি উদ্যান গড়ে তোলারও প্রস্তাব রয়েছে পরিকল্পনায়। প্রস্তাবিত পার্ক এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নদীতীরবর্তী এলাকাকে বিশেষভাবে বিচেনায় নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় এসব পার্ক উন্নয়নে জমি অধিগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। অনলাইন-অফলাইনে খসড়া ড্যাপের ওপর সাড়ে আট হাজারের মতো মতামত পাওয়া গেছে। বিভিন্ন বৈঠকে পাওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে শিগগিরই প্রস্তাবিত ড্যাপের গেজেট জারি হতে পারে।
সোহারাওয়ার্দী উদ্যান :
ঘোড়দৌড়ের মাঠ বা রেসকোর্স ময়দান বললে এ প্রজন্মের লোকদের চিনতে কষ্ট হবে। কারণ, তারা এই ময়দানকে চিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে। অনেকে জানে না, এটি আগে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বঙ্গবন্ধু এ উদ্যানের নামকরণ করেছিলেন সোহারাওয়ার্দী উদ্যান। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রিমিয়ার এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দীক্ষাগুরু। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুসারে সিটি করপোরেশন (তখন পৌরসভা) তাতে উদ্যান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয় এবং তা এখন পরিপূর্ণ উদ্যান।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে এ ময়দানটার একটা ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। ৭ই মার্চ ঘোড়দৌড়ের মাঠে বঙ্গবন্ধু জনসভা আহ্বান করেন। ওই জনসভায় ১০/১২ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর তার ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। জেনারেল নিয়াজী এখানেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
রমনা পার্কঃ
ঢাকার দূষিত বাতাসের মাঝে সতেজ বাতাসের বিশাল ভাণ্ডার রমনা পার্ক (Ramna park) কে বলা হয়ে থাকে ঢাকার ফুসফুস। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততম যান্ত্রিক কোলাহল থেকে আপনাকে একটু হলেও প্রশান্তি এনে দিবে- চিরসবুজ এই উদ্যানটি। রমনা পার্ক বাংলার সাংস্কৃতিক- ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। পার্কটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের “গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের” অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
রমনা পার্ক (ramna park) বাংলাদেশের অতিপ্রাচীন একটি পার্ক। ১৬১০ সালে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁর শাসনামলে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় উদ্যানটির নাম ছিল “বাগ-ই-বাদশাহি” যা ১৮২৪ সাল পর্যন্ত একই নামে পরিচিত ছিল। সে সময়ে উদ্যানটি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল।
এখনকার সোহরাওয়ারদী উদ্যান কিন্তু তখন এই রমনা পার্কের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর রমনা এলাকা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ সময় নবাবেরা উদ্যানটিতে একটি রাজকীয় বাগান গড়ে তোলেন যার নাম দেয়া হয় “শাহবাগ”। এমনকি নবাবেরা এখানে একটি চিড়িয়াখানা গড়ে তুলে। পরে চিড়িয়াখানা মিরপুরে স্থানান্তর করা হয়। রমনা পার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোদন করা হয় ১৯৪৯ সালে। উদ্ভোদনের সময় পার্কের আয়তন ছিল ৮৮.৫ একর এবং তখন ৭১ প্রজাতির গাছ ছিল। স্থান স্ংকটসহ বিভিন্ন কারনে বর্তমানে পার্কতির আয়তন আরও ছোট হয়ে ৬৮.৫ একরে ঠেকেছে।
বৃক্ষের নানা বৈচিত্রময় প্রজাতিও লালন করে আসছে উদ্যানটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রেইনট্রি, মেহগনি, বিরলপ্রজাতির “মহুয়াগাছ” ও “পাদাঊক গাছ”।
রমনা পার্কে গেলে সবসময় কোনো না কোনো ফুলের দেখা মিলে। এর কারন রমনা উদ্যানে রয়েছে নানা প্রজাতির ফুলগাছ। বসন্তে রমনা পার্কের রক্তিম কৃষ্ণচূড়া, বর্ষার কেয়া আর হেমন্তের পিতপাটলা উদ্যানটিকে পরিনত করেছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এখানে আরও দেখতে পাওয়া যায় বিরল “অশোকবিথি”।
প্রতি বছর এই রমনা পার্কের বটমূল মেতে ওঠে বাঙালি নববর্ষ “পহেলা বৈশাখ” উৎযাপনে। এই বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রমনার বটমুল এইদিন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
সকালের মৃদুমন্দ ঝিরঝিরে বাতাসে এমন অসংখ্য প্রকৃতি অনুরাগী ব্যয়াম করতে বের হয়
শুধু সাংস্কৃতিক কারনেই যাবেন ব্যাপারটিও ঠিক সেরকম নয়। ঢাকা শহরে যেখানে দম ফুসরতের ঊপায় নেই, একটিবারও সতেজ বাতাস গ্রহনের সুযোগ নেই, চারদিকে ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন-সেখানে রমনা পার্কে পাবেন চমৎকার সতেজ-নির্মল বাতাস।