টিটকারির শিকার হয়েও তাসকিনের বাংলাদেশের নায়ক হয়ে ওঠার গল্প

‘দেখো বাবা, সবাই তো সবাইকে ভালোবাসে না, আজকে যে ভালোবাসে না সে আবার একদিন ভালোবাসবে আমার খেলা দেখে,’- তাসকিন এভাবেই নিজেকে বোঝাতেন যখন জাতীয় দলের বাইরে থেকে নিজে নিজে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, বিবিসিকে বলছিলেন তাসকিন আহমেদের বাবা আবদুর রশিদ।
আবদুর রশিদ বলেন, ‘এখন দেখেন এটাই কিন্তু সত্যি হলো, আজকে কেউই তাসকিনের বিরুদ্ধে কথা বলবে না, ওকে নিয়ে হাসবে না।’
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্বাগতিকদের হারিয়ে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের নায়ক তাসকিন আহমেদ।
তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের দুই ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ইতিহাস গড়েছে বুধবার।
বাংলাদেশের দুই জয়েই বড় অবদান রেখেছেন তাসকিন আহমেদ, একটিতে ৩ উইকেট নিয়ে আরেকটিতে ৫ উইকেট, তিনিই এই সিরিজের সেরা বোলার।
২০১৯ বিশ্বকাপে তাসকিন আহমেদ সুযোগ পাননি। তিনি ফিট হওয়ার চেষ্টা করার পরও শেষ পর্যন্ত নির্বাচকরা অন্য বিকল্প দেখেন। তাসকিন সেবার মিরপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একাডেমি ভবনের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এই দৃশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের অনেকের কাছেই পরিচিত, একই সাথে পরিচিত তাসকিন আহমেদের পরিশ্রমের নানা ছবি।
নানা সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাসকিন শরীরচর্চার ও নিজেকে তৈরি করার ভিডিও ও ছবি দিতেন, একে তো জাতীয় দলে নেই, অনেক দিন পারফর্ম করেও দেখাতে পারেননি তখন। তাই তাসকিনের এসব ভিডিওতে অনেকেই টিটকারি করতেন মন্তব্যের ঘরে, অনেকেই লিখতেন ‘লোকদেখানো অনুশীলন’।
কিন্তু তাসকিনের বাবা বলেছেন, জাতীয় দলের বাইরে থেকে নিজেকে ঠিক রাখা, লাইনে রাখা, ফিট রাখা খুবই কঠিন, তাসকিন সেটাই করে দেখিয়েছেন।
তাসকিন নিজেও ম্যাচ শেষে পরিশ্রমের ব্যাপারটা লুকোননি, মুখে হাসি রেখে বলেছেন, ‘আমি কেবল প্রসেসটা ঠিক রেখেছি।’
২০১৯ বিশ্বকাপের পরে এলো কোভিড, সেসময় বিশ্বব্যাপীই খেলাধুলা বন্ধ, তাসকিন আহমেদ এই সময়টা বেছে নিয়েছেন ব্যক্তিগত ট্রেনার নিয়োগ দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টেই হলরুমে চালিয়ে গেছেন শরীর ঝালাইয়ের কাজ।
তাসকিন আহমেদের বাবা আবদুর রশিদ বলেছেন, ‘বাইরে থেকে অনেক কিছুই বলা যায়, আমরা আসলে এই সময়টার অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ মাঠে না খেললে তো মুখ ফুটে কিছু বলাও যায় না।’
‘আজকে আমার ছেলের নাম ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, লাসিথ মালিঙ্গার পাশে। সামনে আরো বড় জায়গায় যাবে এটাই স্বপ্ন দেখি।’
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রতিপক্ষ দলের কোনো ফাস্ট বোলার শেষবার ৫ উইকেট পেয়েছিলেন ২০১২ সালে- লাসিথ মালিঙ্গা। এর আগে ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস এই কীর্তি গড়েন। সেঞ্চুরিয়নে তৃতীয় ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিয়ে তাদেরই পাশে নাম বসিয়েছেন তাসকিন আহমেদ।
এর আগে তাসকিন ৫ উইকেট পেয়েছিলেন ৮ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে ঢাকার মিরপুরে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের চতুর্থ বোলার হিসেবে একাধিকবার ৫ উইকেট পেলেন তাসকিন আহমেদ।
তাসকিন আহমেদ এই সাফল্যে আটকে থাকতে চান না বলে জানিয়েছেন ম্যাচের পরে। আর ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কথা বললেই সবাই অফ স্পিনার, বাঁহাতি স্পিনারদের কথা বলে, কিন্তু এবারে ডান হাতি পেস বোলার আমাদের সিরিজ জেতালো এটা একটা বড় ব্যাপার।’
তামিম নিজের আনন্দ লুকোননি, ‘তাসকিন যখন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ও ম্যান অফ দ্য সিরিজ পুরস্কার পেলেন আমার খুব গর্ব লাগলো।’
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে জয়ের পর তামিম মজা করেই বলেন, ‘তাসকিনের পরিশ্রম আপনারা সবাই দেখেন কারণ ও ইন্সটাগ্রামে দেয়।’
তবে প্রশংসা করতেও ভুলেননি তিনি, ‘আমার মনে হয় সবাই হার্ডওয়ার্ক করে। তাসকিন অনেক বদলেছে বছরের পর বছর পরিশ্রম করে। আমি অনেক সময় যদি জিম না করতে চাই ও আমাকে টেনে নিয়ে যায়।’
তাসকিন আহমেদ এরই মধ্যে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ডাক পেয়েছিলেন, লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস থেকে এবং ভারতের ক্রিকেট বোর্ড থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করা হলে বিসিবি জানিয়ে দেয় সিরিজের মাঝপথে তাসকিন আহমেদকে ছাড়া হবে না।
তাসকিনও এনিয়ে কোনো আক্ষেপ প্রকাশ করেননি।
তামিম ইকবাল ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাসকিন যখন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ও ম্যান অফ দ্য সিরিজের পুরস্কারটা পেল তখন আমি ওকে গিয়ে বলি, এটাই তোর আইপিএল।’
তাসকিন আহমেদের আবদুর রশিদ, বাবা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দেখেন আইপিএলের ফাইনাল জিতেও কি এই আনন্দ পাওয়া যেত? পুরো দেশ এখন তাসকিনকে নিয়ে মাতামাতি করছে। এটা হতো তখন?’
‘এভাবে যদি তাসকিন পরিশ্রম করতে থাকে তাকে নিতে বাধ্য,’ বলেন তাসকিনের বাবা।
তিনি তাসকিনকে একদিন বিশ্বের সেরা দশ বোলারদের তালিকায় দেখতে চান একদিন।
তাসকিন আহমেদের ক্যারিয়ার কেমন ছিল
তাসকিন শুরু করেন বড় মঞ্চ দিয়ে। ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেকেই গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে বোল্ড করে দেন তিনি।
এরপর একই বছর ওয়ানডে অভিষেকই ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট।
তাসকিনের সাথে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা জুটি বেঁধে বল করতেন, উদযাপন করতেন। মাশরাফীর সাথে বুকে বুক মিলিয়ে উদযাপনটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরিচিত এক দৃশ্য হয়ে উঠেছিল তখন।
এরপর ঘরের মাটিতে মোস্তাফিজ যোগ হওয়ার পর যখন ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ তখন ধারণা করা হচ্ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পেস বোলিং আক্রমণ বাংলাদেশের- মাশরাফী-তাসকিন-মোস্তাফিজ।
কিন্তু ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাসকিন আহমেদের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সে বছরই তিনি শুধরে নিয়ে ফেরত আসেন কিন্তু শুরুর দিকের তাসকিন আহমেদকে আর দেখা যায়নি।
বল হাতে তাসকিনের ধার কমতে থাকে এবং ২০১৭ সালে যোগ হয় ইনজুরি, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তাসকিন আহমেদ।
ফেরেন ২০২১ সালের নিউজিল্যান্ড সফরে, তবে সেই সফরে তার বোলিংটা আশানুরূপ হয়নি।
ধীরে ধীরে তাসকিন পুরনো রূপের চেয়েও ভালো বোলিং করা শুরু করেন, গতির চেয়ে তার লাইন লেন্থ ও ব্যাটসম্যানদের মন বোঝার চেষ্টাটা দেখা যায় মাঠে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে ৪৬ রানে ৪ উইকেটের পর আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ে সিরিজে ভালো বোলিং করেছেন তাসকিন।
এবারে দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই ‘ভালোকে আরো একধাপ ওপরে নিয়ে এসেছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। সূত্র : বিবিসি