সায়মা ওয়াজেদ পুতুল : বিশ্বমানবের কল্যাণে নিবেদিত নিভৃতচারী এক আত্মপ্রত্যয়ী নারী

জাকির হোসেন জুমন :
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে সদ্যসমাপ্ত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) এর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এর কপ-২৬ এ তিনটি কর্মব্যস্ত দিন স্বচক্ষে দেখার মাধ্যমে যে এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন আসলেই কষ্টসাধ্য।
সম্মেলনের ১ম দিনে সকালের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন বিশেষ কয়েকটি মিটিংয়ে উপস্হিত হতে রওয়ানা করলেন ঠিক তখনই আমি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আসি। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম প্যাভিলিয়নের ভিতরের কক্ষে অনেক লোকের আনাগোনা। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশে থেকে একজন বললো পুতুল আপা এখানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছেন। একটু বুঝার চেষ্টা করলাম এবং এটুকু বুঝতে দেরী হলোনা যে সবাই যার যার অবস্থান জানানোর জন্যই তেমন কোনো কারণ ছাড়াই পুতুল আপার মিটিং রুমে একটু পর পর ঢুকছেন এবং বের হচ্ছেন। আমি দ্রুত মিটিং রুমে ঢুকলাম এবং পুতুল আপার সাথে কুশলাদী বিনিময় করে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো যে মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কেউ রুমে ঢুকতে পারবেনা।
বাংলাদেশ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় অনেকেই জেনে গিয়েছেন যে পুতুল আপা এখানে আছেন। একে একে অনেকেই আসলেন আর অনুরোধ করতে শুরু করলেন একবার শুধুমাত্র সালাম দিবেন পুতুল আপাকে। বিনয়ের সাথে সবাইকে বুঝিয়ে বললাম। এতক্ষণে ঘড়ির কাটা বিকেল ৪টায়, সামনে দাঁড়ানো দুজন বিদেশি ভদ্রলোক, সাথে টিভি ক্যামেরা। উনাদেরকে বাইরে রেখে আমি পুতুল আপার মিটিং রুমে ঢুকলাম এবং অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কথা জানালাম, উনি ততক্ষণে পূর্বের মিটিংয়ের শেষ প্রান্তে । মিটিং এর পর সবকিছু ঠিক করে সাক্ষাৎকার শুরু করলেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দিতে হয়নি। উনার আত্মবিশ্বাস এমন ছিলো যে,নিজের কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন উনার চোখের মধ্যে ফুটে উঠেছিল নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদের কথা। মনে হচ্ছিল উনি বিশ্বের প্রতিটি বাস্তুচ্যুত মানুষের এক একটি কষ্টের গল্প তুলে ধরছেন সবার সামনে। যথারীতি সাক্ষাৎকার শেষ হলো এবং ঘড়িতে ততক্ষণে বিকেল ৫:০০টা। আমি জানতে চাইলাম উনি দুপুরের খাবার খেয়েছেন কি না, উনি বললেন সময় পাননি।
আমি বললাম বাইরে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী অপেক্ষায় আছে, আপনি চাইলেও দ্রুত বের হয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। উনি বললেন সবার সাথে কথা বলে যাবো তবে সবাইকে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে হবে। পুতুল আপা বের হলেন এবং সবার সাথে ধৈর্য্য সহকারে হাস্যোজ্জ্বল ভাবে কথা বললেন। তারপর আমি আর পুতুল আপা হাঁটা শুরু করলাম, পিছন থেকে পুতুল আপাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখছেন দুজন এস.এস.এফ সদস্য। যদিও পুতুল আপা খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কিন্তু নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে যারা থাকেন তারা সবসময় উনার স্বাধীন,স্বা ভাবিক চলার পথ থেকে একটু দূরত্বে থাকতে হয়। বিষয়টা আমি পূর্বেই জানতাম কিন্তু এতটা স্বাভাবিক থাকতে চান সেটা না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রোগ্রাম ছিলো স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নে। প্রোগ্রাম শুরুর একটু পর গোলাপী রংয়ের জামদানী শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে উপস্হিত হলেন পুতুল আপা। উনাকে সামনের সারিতে একটি চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্হা করলেন স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নের কর্মকর্তারা। মনোযোগ সহকারে পুরো মিটিং জুড়ে সবার বক্তব্য শুনলেন পুতুল আপা। প্রোগ্রাম শেষে কেউ একজন পুতুল আপাকে কয়েকটি বই দিতে চাইলে পুতুল আপা আমাকে ডেকে বললেন বইগুলো আমার কাছে রাখতে এবং যাবার সময় যাহাতে মনে করে বইগুলো উনাকে দেই। তারপর উনি হাঁটতে শুরু করলেন।
এক এক করে পুতুল আপার সাথে অনেকগুলো প্রোগ্রামে উপস্হিত হলাম। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে উনার যে সম্পর্ক তা আমাকে বিস্মিত করেছে। সবাই হাসি মুখে প্রতিটি প্রোগ্রামে উনাকে স্বাগত জানালেন। প্রিন্স চার্লস, বরিস জনসন, বিল গেইটস, জন ক্যারিসহ বিশ্বের প্রায় সকল নেতৃবৃন্দের সাথে উনার যে নিবিড় সম্পর্ক তা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ। কয়েকটি প্রোগ্রাম শেষ করতেই ঘড়িতে প্রায় ২টা বেজে গেছে। পুতুল আপা আমাকে বললেন উনার একজন বন্ধু এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সহযোগী কর্মকর্তা উনাকে খুঁজে পাচ্ছেন না, যদি সম্ভব হয় তাহলে খুঁজে বের করতে। বিশাল এলাকায় কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন বিধায় পুতুল আপা উনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন তার অবস্থান কোথায় এবং সেই প্যাভিলিয়নের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তারপরও অনেকক্ষণ লেগে গেলো উনাকে খুঁজে পেতে।
এরপর আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড়ানোর পর আমি কাউন্টারে এসে খাবার ওর্ডার করলাম। পুতুল আপা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন আমি যেনো উনার জন্য মাছ বা ভেজিটেবল জাতীয় খাবার নিয়ে আসি। আমি খাবার নিয়ে আসলাম এবং এরপর যা হলো তা অবিশ্বাস্য। পুতুল আপা চেয়ার থেকে উঠে আমাকে বললেন তুমি অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলে এখন তুমি একটু বসো। আমি হতবাক্ হয়ে তাকালাম উনার দিকে আর বললাম আপা এটা কী কোনোদিন সম্ভব যে আপনি দাঁড়াবেন আর আমি বসবো আপনার সামনে, দয়াকরে আপনি বসেন।
পরবর্তী মিটিংয়ে যেতে যেতে আমাকে বললেন উনার বন্ধুর সাথে কয়েকটি ছবি উঠাবেন, আমি যেন মিটিং শেষে ছবিগুলো উঠিয়ে দেই। উনার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটি ছিলো, আমি অনেকবার অনুরোধ করে বললাম ব্যাগটি আমার কাছে দেয়ার জন্য, উনি বললেন আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি,তা ছাড়া আমার ব্যাকপ্যাক তুমি কাঁধে নিবে এটা দৃষ্টিকটু দেখায়। আরো অনেক বিষয়ে আলাপ করলেন, বাচ্চাদের খবর নিলেন, এলাকার খবর নিলেন, দেশকে নিয়ে উনার বিভিন্ন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বললেন এবং বিশেষ করে উনার জীবনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় জিনিস আমাকে জানালেন, আমিও অভিভূত হয়েছি এবং শিখেছি অনেক।
সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাকে আবেগতাড়িত করেছে সেটা হলো একজন বাঙালি নারী হয়ে কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে উনাকে আজকের এই জায়গায় আসতে সেই যাত্রাপথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ ছিলো তা আমাকে বুঝালেন। তবে যে বিষয়টি উনি কথা বলতে চাননি তা হলো রাজনীতিতে উনার আগ্রহ বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি যদিও আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম কয়েকবার। মিটিং শেষে উনার ছবি তুলে দিলাম এবং তার একটু পরেই আমি বহির্গমন গেট পর্যন্ত হেঁটে বিদায় জানালাম এবং উনি চলে গেলেন হোটেলের উদ্দেশে।
তৃতীয় দিন সকাল বেলা কনফারেন্স ভেন্যুতে আমরা উপস্হিত হয়ে দেখলাম পুতুল আপা ইতিমধ্যেই এসে একটি মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। আমি ঐ মিটিং রুমে ঢুকতেই উনি মঞ্চ থেকে মৃদু হেসে আমার উদ্দেশে হালকা হাত নাড়েন। আমি একটু পরই সামনে এগিয়ে গিয়ে উনার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি নিলাম। মিটিং শেষ করে পুতুল আপা আরও কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিলেন এবং উনার বিনম্র কথার মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ শব্দচয়নে সাংবাদিকবৃন্দ উদ্বেলিত হয়েছেন। পাশে বসে প্রতিটি সাক্ষাৎকার যখন শুনেছি তখন নিজে নিজেই হিসেব কষে নিয়েছি যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এমনই হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যার সাথে কথা বললে মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলছি, যার ভাবনা বা পরিকল্পনা শুনলে মনে হয় বিশ্ব নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ অংশীদার, যে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে, যার ধমনীপ্রবাহে বাংলাদেশের গল্পগাথা তার কাছে যদি আসে আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তাহলে দেশ হবে বহির্বিশ্বের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
সবকিছুর পর একটি জিনিস সত্য আর সেটা হচ্ছে রক্ত কথা বলে। আল্লাহর অশেষ নিয়ামত বঙ্গবন্ধুর উপর ছিলো এবং উনি ৭ কোটি বাঙালি থেকে আলাদা কিছু গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন বিধায় উনার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম দেশ। আর তাঁরই রক্তের ধারা বহমান তাঁর বংশের প্রতিটি মানুষের শরীরে। তারা আপনার আমার মত স্বাভাবিক চলনে-বলনে কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের উর্বরতা বা ধারনক্ষমতা কিংবা চিন্তাভাবনার পরিধি আপনার আমার চেয়ে অনেক অগ্রগামী। আসলে আমি নিজেই বিস্মিত হয়েছি বারবার, যখনই উনি সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন,তা একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে আপনার আমার চিন্তাভাবনায় আসবে না। উনার চিন্তাভাবনা আপনার আমার মস্তিষ্কের থেকে অনেক ভিন্ন এবং এডভান্সড। দেশ নিয়ে উনার বা উনাদের পরিকল্পনা আমাদের আশার থেকেও অত্যাধুনিক তাইতো তরুণ প্রজন্মের অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সবটুকু জুড়েই বঙ্গবন্ধু পরিবার।
আজ ৯ই ডিসেম্বর, পুতুল আপার জন্মদিন। আমি দোয়া করি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ উনাকে জানার সুযোগ যেন পায়। আপনারা সবাই উনার দীর্ঘায়ু ও কল্যাণময় জীবন কামনা করে দোয়া করবেন। শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধেয় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আপা।
(লেখকঃ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং কপ-২৬ সম্মেলনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী )