ঘাটের কথা

 প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২২, ০৬:০১ অপরাহ্ন   |   সাহিত্য-সংস্কৃতি


নান্টু ভাই আমার পাঠক। আট বছর আগে সে আমাকে মাঝেমাঝে ফোন দিত। তখন কলচার্জ ছিল মাত্রাধিক। কেমন আছেন, কি করছেন। এ কথাগুলোই ছিল তার আলাপের সীমা। জানতে চেয়েছিলাম তার পেশা। তিনি বিচিত্র কায়াদায় হাসলেন। বললেন আমি একটা ঔষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। মাওয়া ঘাটের পাশেই সে থাকত। আমার প্রকাশিত একটা গল্পের সাথে তার জীবনের মিল আছে। 

যখন জানলেন আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং মাওয়া দিয়ে আমার যাতায়াত। তাই তিনি বারবার আমাকে দেখা করতে বলতেন।

দুর্যোগকালীন আবহাওয়ায় আমি পদ্মার পাড়ে ছিলাম। উত্তাল পদ্মা। স্পিড বোট,লঞ্চ এমনকি ফেরী বন্ধ। চরম বিপত্তি ঘটল হাজার মানুষের। তখন রাত আট।

সে বৈরী আবহাওয়ায় তিনি আমাকে পেয়ে বিস্মিত। এক উজ্জ্বল আভা তার চোখে, পাতলা ফিনফিনে দেহ। সৌম্য আর মার্জিত। আমি থাকার জন্য বোডিং খুজি। তাতে তার তীব্র আপত্তি। সেই রাতে  আমি নান্টু ভাইয়ের মেহমান হলাম। আমাকে সে অতিমাত্রায় গুরুত্ত্বের সাথে বিবেচনা করল। পদ্মার ইলিশ আর তার আন্তরিক ভালবাসায় এক দারুন নৈশভোজ হল।

তার বাহ্যিক বিষয়ের সাথে সম্পুর্ন অমিল তার ঘর। ছোট একটা টিনের ঘর।সারা ঘরে হার্বাল ঔষুধের কৌটা,মোড়ক। লঞ্চে, ফেরীতে সে এই ঔষুধ বিক্রি করে। মোড়কের কথা গুলো ছিল আপত্তিকর, আর তথাকথিত। এই সব ঔষুধে সব রকম রোগ নিরাময় এর নিশ্চয়তা।

তার লুংগি আর প্যান্টকে মিশ্রিত করে বালিশ বানানোর বৃথা চেস্টা চলছিল। আমি বাধা দেই। এক বালিশেই এক রাত... কত বিচিত্র গল্প।

দারিদ্র্যেতার কষাঘাতে ষষ্ট শ্রেনীতে পড়ার সময় তার মা বিষ পানে আত্মহনন করেন। জীবনের মোড় সেখান থেকেই ঘুরে যায়। বিমাতার যন্ত্রনায় ঘর ছাড়া একদিন হই। এক জেলা থেকে অন্য জেলা। এভাবেই চলে আসি পদ্মার পাড়ে। কখন ফল বিক্রি করে,কখনো ডিম কিংবা কুলিগিরি করে দিনাতিপাত করতাম।

বর্তমান তার পেশা অনৈতিক। কিন্ত লাভ বেশি। মেয়াদ শেষ, কৌটায় যোগ হয় নতুন লেবেল। কিন্ত জীবন থেকে সততা বিয়োগ হয়ে যায়। মিথ্যা কথার মারপ্যাঁচ আর সাধারণ সহজ সরল মানুষকে সম্মোহিত করে ঔষুধ বিক্রি..... তার বলা শেষ হল।

বৃষ্টি আমার প্রিয়। ঝমঝম বৃষ্টিতে ম্রিয়মাণ হয়ে গেল তার বিবর্ণ গল্পে।

আট বছর পরে... গতকাল মাওয়া ঘাটে ছিলাম। কে যেন পিছন থেকে ডাকছে। সেই নান্টু ভাই। যে আমাকে ধার করে পদ্মার ইলিশ কিনে খাইয়েছিল।

নান্টু ভাই আজ বলিষ্ঠ। তেজস্বী। তাকে দেখে সেই বৃষ্টিময় রাত উজ্জ্বল হয়ে গেল আমার স্মৃতিপটে। নান্টু ভাই আমার কাছে বিশেষ অর্থে কেউ ছিল না। তাই এই আট বছরে তাকে খোঁজ করিনি।


সে এখন মাওয়া ঘাট থেকে শ্রী নগর পযর্ন্ত অটো রিক্সা চালায়।

এক কাপ চা খাবার আবেদন। সৌজন্যেতার জন্য না করতে পারিনি। আমি হাস্যজ্বল প্রশ্ন করি- কোথায় ছিলেন এতদিন?

সেও হাসল। আমি নাকি কবি মানুষ। গল্প খুজি। তার গল্প সে আমাকে শোনাতে চায়।

....মালয়েশিয়া যাবার প্রস্তাব ছিল। বিনিময়ে হেলেন কে বিয়ে। আমার কল্পনায় ঝলমলে মালয়েশিয়া। বিয়ের তৃতীয় দিনে জানতে পারি হেলেন ব্যভিচারিণী। এর আগেও দুইবার ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মন থেকেই মেনে নিয়েছিলাম। হেলেন যথেষ্ট দায়িত্ত্ববোধ নিয়ে আমার দেখাশোনা করত। ভালবাসার বন্ধনে আমি এই প্রথম এক মায়ায় জড়ালাম। নিগুড় বিশ্বাস জন্ম নিল তার প্রতি আমার।

তিন মাসের সংসার। তারপর মালয়েশিয়া। হেলেন কে তীব্রভাবে অনুভব করতাম। হেলেন এর চাহিদা ক্রমশ বাড়তে লাগল। তাই জহরবারু,কুয়ান্টান থেকে মালাক্কা সব খানেই দিন রাত কাজ করে বেড়তাম। দিন থেকে রাত। পরিশ্রম করে ক্লান্ত হলেও হেলেন এর ভালবাসা আমাকে জাগিয়ে দিত।

হেলেন জমি কিনবে,সাত লক্ষ টাকা লাগবে। আমার স্বপ্নে যোগ হয় একটা ঘর। একটা সন্তান। আমার মালিক থেকে লোন বাবদ সাত লক্ষ টাকা নিয়ে হেলেন কে পাঠালাম।

কিছু দিন পর সেই খবর এল। হেলেন নিরুদ্দেশ। একা নয়। আমার পাঠানো সব টাকা নিয়েই। দেশে আসার উপায় ছিল না। মালিকের সব দেনা কাজ করে শোধ করেই দেশে আসি। চেস্টা করেছি হেলেন এর মুখোমুখি হতে। কিন্তু সে এখন অন্য সত্তা  নিয়ে ব্যস্ত। জবাবদিহিতা তাই নিষ্প্রয়োজন। আমার সান্তনা একটাই-আমি জগতের শ্রেষ্ট নির্বোধ। আমার বিশ্বাসের যোগ্য কেউ নেই। আমার জগতে আমি এখন একা।

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তার কাঁধে হাত দেই। সে মৃদু হাসে। অদ্ভুত এক আলিংগনে তাকে জড়িয়ে ধরি। অনুধাবন করার চেস্টা করি তার বুকে কত জ্বালা।

আমি তাকে সেলফি তোলার প্রস্তাব দেই। সে পুরাতন কায়দায় হাসল।
সেলফি তুলিবেন?
ফেসবুকে দিবেন?

না। আপনার ব্যক্তিত্ব আর স্বতন্ত্রতা আমার নিজের কাছে অমুল্য সম্পদ হিসাবে রাখব। এ ভালোলাগা আমার একান্ত। তা কারো কাছে প্রকাশ করব না।

আমার ফেরার তাড়া ছিল। সে বলল দ্রুত যান. আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে। অথচ আমার জন্য কেউ নেই অপেক্ষা করার। সিগারেট এর প্যাকেটে যেমন লেখা থাকে ধুমপান দেহের জন্য ক্ষতিকর। বাসে যেমন লেখা থাকে -অপরিচিত কারো দেয়া কিছু খাবেন না। তেমনি আমি আমার অটো রিক্সার পিছনে লিখেছি "হে পৃথিবীর মানুষ, পৃথিবীতে কাউকে সম্পুর্ন বিশ্বাস করবে না"।


শুভ পাল
গুলশান দুই
০১৯১৪-৪২১৪৭৮