বেলাবোতে আড়াই হাজার বছর আগের অসম রাজার ঘর আবিষ্কার

মোঃ দিদার হোসেন পিন্টু, (বেলাবো, নরসিংদী) : ব্রিটিশ আমলে নরসিংদী ছিল নারায়নগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৭ সালে নরসিংদী মাহকুমায় উন্নীত হয়। বর্তমানে ছয়টি উপজেলা নিয়ে (নরসিংদী সদর, বেলাব, মনোহরদী, পলাশ, রায়পুরা ও শিবপুর) নরসিংদী জেলা গঠিত। নরসিদী জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের উয়ারী বটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন একটি এলাকা।বেলাবো উপজেলায় এর অবস্থান। মূলত উয়ারী এবং বটেশ্বর আলাদা দুইটি গ্রাম। কিন্তু এদের পরিচয় এখন আর আলাদা নেই বরং একাকার হয়ে গেছে।
সাধারণ গ্রাম, প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে এর অসাধারণ ইতিহাস। পাওয়া গেছে ৩ হাজার বছর পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন। এর মাঝে আছে, প্রাচীন শিলালিপি, মুদ্রা, পাথর, ছোট ছোট নানান খোদাই করা অবয়বসহ আরও অনেক কিছু!
এখানে পাওয়া গেছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে তাম্র প্রসার যুগ, আদি-ঐতিহাসিক যুগ, প্রাক-মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল তার নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ আবিষ্কার করেছেন ফসিল-উড ও পাথরের তৈরি প্রগৈতিহাসিক যুগের হাতিয়ার ও তাম্র-প্রসার যুগের গর্ত বসতির চিহ্ন। এছাড়া এ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ৬০০মি. x ৬০০ মি. আয়তনের চারটি দূর্গ প্রাচীর, দূর্গ প্রাচীরের চারিদিকে রয়েছে পরিখা যা চোখের দৃষ্টিতে সহজেই অনুধাবন করা যায়।
উয়ারী দূর্গের পশ্চিম দক্ষিণে প্রায় ছয় কি. মি. দীর্ঘ এবং ২০ মিটার প্রশস্ত- ১০ মিটার উঁচু অসম রাজার গড় নামে একটি মাটির বাঁধ রয়েছে। তাছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখানে গলিপথসহ ১৬০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তত্বাবধানে এখনো খনন কাজ চলছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকগণ দাবী করেছেন উয়ারী-বটেশ্বর ছিল প্রাচীন গঙ্গারিডি রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত। দিলীপ কুমার চক্রবর্তী (অধ্যাপক, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলোজি, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি) মনে করেন যে, উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। কারণ প্রাপ্ত রুলেটেড মৃৎপাত্র, স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ এ তথ্যের সত্যতার প্রমাণ দেয়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলটি টলেমি (দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ) উল্লেখিত ‘সোনাগড়া’। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একক রঙের কাঁচের পুঁতি উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়াও শ্রীলংকার মানটাই, দক্ষিণ ভারতের আরিকামেদু, থাইল্যান্ডের কিয়ন থম প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে অষ্টমবারের খনন কার্যে পাওয়া যায় একটি বৌদ্ধ পদ্ম মন্দির। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, উয়ারী বটেশ্বরে কেবল নগরায়নই ঘটেনি, ব্রহ্মপুত্র নদের উপস্থিতির কারণে এ অঞ্চল একই সঙ্গে ছিল নদীবন্দর এবং বাণিজ্য নগর।
উয়ারী গ্রামের স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান প্রথম এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অনুধাবন করেন। ১৯৩৩ সালে শ্রমিকরা খনন করতে গিয়ে এখানে কিছু মুদ্রা পান। এগুলো সংগ্রহ করেন হানিফ পাঠান। তখন থেকেই তিনি এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। নিজ উদ্যোগে কিছু খননও করেন। তার প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে এই সংগ্রহশালা আগলে রেখেছে তার বড় ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠান বলেন,উয়ারী-বটেশ্বর সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলােচিত প্রত্নস্থান। কৃষিজমি, বাগানবাগিচা ও ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে আছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন একটি নগর। উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের ৫০ টি প্রত্নস্থান থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর ও প্রস্তুরীভূত জীবাশ্ম -কাঠের হাতিয়ার, তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির গর্ত-বসতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন করে লেখার তাৎপর্যপূর্ণ সব প্রত্নবস্তু। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম মহা জনপদ। দুর্গ নগরটি ছিল সেই মহা জনপদের রাজধানী। এটি গড়ে উঠেছিল সুপরিকল্পিতভাবে। ইতিমধ্যে এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পাকা রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তাসহ ইটনির্মিত অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি নদী বন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। মনে করা হচ্ছে, টলেমি বর্ণিত সৌনাগড়াই উয়ারী বটেশ্বর।আরও মনে করা হচ্ছে, উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে ছিল গঙ্গাঋদ্ধি জাতির বাস। ভারতীয় উপমহাদেশের আদি ঐতিহাকি কালের অনেক নগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল উয়ারী-বটেশ্বরের। ২৩০০ বছরের প্রাচীন ৪০০০ কিলােমিটার দীর্ঘ বিশ্ববিখ্যাত সিল রুটের সঙ্গেও যে উয়ারী বটেশ্বর সংযুক্ত ছিল, নানা নিদর্শনগত প্রমাণ থেকে সম্প্রতি তা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। উয়ারী-বটেশ্বরে বিকশিত হয়েছিল স্বল্পমূল্যবান পাথরের নয়নাভিরাম পুঁতি তৈরির কারখানা। এখানে আবিষ্কৃত উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও মুদ্রাভান্ডার , অনন্য স্থাপত্যকীর্তি হরেক রকমের পুঁতি, সুর্দশন লকেট ও মন্ত্রপূত কবচ, বাটখারা, পােড়ামাটি ও ধাতব শিল্পবস্তু, মৃৎপাত্র, চিত্রশিল্প ইত্যাদি শিল্পীর দক্ষতা, উন্নত শিল্পবােধ ও দর্শনের পরিচয় বহন করে।
ওয়ারী যে সকল স্থান থেকে বেশি পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে , টঙীরটেক,রাঙের টেক,বটেশ্বর,বেলাবো, রাজার সহ বেশ কিছু স্থানে।