ঘুমের সময় অসময়

ডা. মো. ছায়েদুল হক:
জীবনের গল্প মানেই সাফল্য আর ব্যর্থতার গল্প।পিছনের কর্মব্যস্ততার গল্প।দিনশেষে কেবলই সমাপ্ত, অসমাপ্ত কাজের কাজের ফিরিস্তি।ভালো লাগা মন্দ লাগা এসব দিয়েই পসর সাজানো দিনলিপি। কেউবা পরিকল্পনায় সাজায় জীবন অথবা কেউ অদৃশ্য ভাগ্যের বেড়াজালে বন্দী।তবে দিনশেষে সবার গন্তব্য একটাই ঘুমের রাজ্যে অবগাহন। দিনের শেষে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং কাজের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তখন সে বাধ্য হয়ে ঘুমের কোলে আশ্রয় নেয়। একমাত্র ঘুমই কেবল একজন পরিশ্রান্ত মানুষকে আবারও কাজের উপযোগী করে হাজির করতে সক্ষম।পরিশ্রান্ত একজন মানুষ কেবল ঘুমের মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে আবারও জীবনের কর্মস্রোতে নতুন উদ্যমে ফিরে আসে।ঘুমের জন্য নির্ধারিত রাতের অন্ধকার আর কাজের জন্য নির্ধারিত দিনের আলো। প্রকৃতি এভাবেই সাজানো।আলো আধারের এই নিয়মের ব্যত্তয় ঘটিয়ে মানুষ কতটুকু চলতে পারবে অথবা বিপরীত অবস্থান কতটুকু স্বাস্থ্যঝূকি সৃষ্টি করবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার প্রচুর অবকাশ আছে।
মানুষের দেহ আসলে ২৪ ঘন্টায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।২৪ ঘন্টা সময়ের কিছুটা আলো এবং কিছুটা অন্ধকার। এই দুইয়ে মিলে একটি চক্র বা হৃদমে চলে দেহ। এটিকে বলা হয় সারকাডিয়াম হৃদম।এই সারকাডিয়াম হৃদমের মাস্টার ক্লক বা ঘড়ি হলো মস্তিস্ক বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় হাইপোথ্যালামাস।এই সেন্টারটি চোখের সাথে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিনের আলো; স্পর্শ; এক্সারসাইজ, সামাজিক কর্মকান্ড ইত্যাদি এই সেন্টারকে উজ্জীবিত রাখে এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য দেহকে তৈরী রাখে।আর এই কাজে হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারী গ্লেন্ডকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে প্রায় সিংহভাগ হরমোনকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে।ফলে দেহ কাজের জন্য যথেষ্ঠ উজ্জীবিত বা এলার্ট থাকে এই সময়টিতে। আবার রাতে বা অন্ধকারে যখন কাজ থাকে না বা দেহ পরিশ্রান্ত থাকে তখন দেহ এই সমস্ত উত্তেজক থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে আড়াল করে নেয় এবং ঘুমের রাজ্যে নিজেকে সমর্পণ করে।
বিশ্রামের জন্য রাত বা রাতের অন্ধকার কতটুকু ভুমিকা রাখে অথবা রাতের অন্ধকারে বিশ্রাম বাদে কাজ কতটুকু সুখকর বিষয়টি সুরাহা করার আগে ঘুমের বিষয়টি একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। এতে অন্ধকারের গুরুত্ব অনুধাবন করা সহজ হবে।দিন রাত বা আলো আধারের বিষয়টি নিবিঢ়ভাবে সন্নিবেশিত প্রকৃতির একটি উপসঙ্গ। মানুষ, জীবজন্তু এমনকি পাখী, ফূল, তৃণলতা ইত্যাদিও অনুভব করে এই আলো আধারের অস্তিত্ব।দিনের আলো নিস্প্রভ হয়ে এলে যেমন পাখীরা নীড়ে ফেরে তেমনি ফুলেরাও জানে কখন নিজেকে মেলে ধরতে হবে বা কখন ঝরে যেতে হবে।মানুষের বেলায় এটি আরও সত্য।ঘুমের বিষয়টি আধারের সাথে নিবিঢ়ভাবে সম্পর্কিত একটি বিষয়।
ঘুমের বিষয়টি হুট করে এসে যায় এমনটি মনে হলেও বিষয়টি এতটা সহজ নয়।ঘুমেরও কতগুলি স্তর অতিক্রম করতে হয়। প্রাথমিকভাবে ঘুম দুটি স্তরে বিন্যস্থ।ননরেম স্লিপ ও রেম স্লিপ।ঘুমের শুরুতেই আসে ননরেম স্লিপ যা প্রায় ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রথম ১০-১৫ মিনিট চোখ বন্ধ হয়ে ধীরে ধীরে দেখা নিস্ক্রীয় হয়ে আসে; পরবর্তী ১০-১৫ মিনিট হালকা ধরণের ঘূম এবং পরবর্তী ১ ঘন্টার মত স্থায়ী গভীর ঘুম। এই স্তরে মস্তিস্ক প্রায় নিস্ক্রিয় থাকে। এরপরেই শুরু হয় রেম স্লিপ। এই স্তরে ঘুমের মধ্যেই চোখ বেশ নড়াচড়া করে, মস্তিস্ক বেশ সক্রিয় থাকে এবং ঘুমের ঘোড়ে স্বপ্ন দেখার বিষয়টি এই স্তরিই সীমাবদ্ব।রেম স্লিপ শেষে আবারও নন রেম স্লিপ।এভাবে কখনও হালকা এবং কখনও গভীর ঘুমের পালাবদল চলতে থাকে। তবে ঘুমের সুফল বয়ে আনে আসলে গভীর স্তরের ঘুম।আর এই গভীর স্তরের ঘুম বেশী উপভোগ করা যায় লম্বা বা দীর্ঘ ঘুমে। এই জন্য হালকা ঘুম; বা অল্প সময়ের ঘুম বা দিবানিদ্রা তেমন একটা ফল বয়ে আনে না।দেহের জন্য প্রয়োজন টানা লম্বা ঘুম।
ঘুমের সময়টিতে খাদ্যের পরিপাক প্রণালী কমে আসে এবং ক্যালরী বা শক্তি খরচ কমে যায়। এই সময়টিতে দেহ থেকে বিশাক্ত ক্যামিকেল দেহ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়; ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র দৈহিক পূণর্গঠন বা ডিএনএ-র পূণর্গঠন প্রক্রিয়া শক্তি পায়; মেমোরি ও মেধাবিকাশে সহায়ক ভূমিকা কাজ করে। দিনের বেলায় যেহেতু দেহকে প্রচুর কাজ করতে হয় তাই দেহকে কর্ম উপযোগী রাখতে বা যথেষ্ঠ উজ্জীবিত রাখতে কেটাকোলামাইন , ষ্টেরয়েড ইত্যাদি হরমোনের প্রাচুরয ঘটে। এসময়টিতে পরিপাকতন্ত্র ও ক্যালরী বা শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া তুঙ্গে থাকে।আর এই সমস্ত কাজে দিনের আলো প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। এভাবেই দিনের বেলায় বা কাজের বেলায় দেহ কেবলই ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং রাতে বা ঘুমে সাড়াদিনের ক্লান্তি হৃাসের পাশাপাশি দেহ মলিকুলার লেভেলের ক্ষতি পুষিয়ে নেয় বা এগুলি পূণর্গঠিত হয়। এভাবেই দেহে প্রতিনিয়ত একদিকে ক্ষয়িস্ঞু ও পাশাপাশি পূণর্গঠন প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকায় দেহঘড়ি সচল থাকে।
এখন কোন কারণে নিদ্রার ব্যাঘাত হলে দেহের পুণর্গঠন প্রক্রিয়া ঝূকিতে পড়ে যায়। তখন রাতের বেলায়ও অধিকতর ষ্টেরয়েড, ক্যাটাকুলামাইন ইত্যাদি হরমোনের প্রাচুরয এবং ইনসুলিনের ঘাটতি বিরাজ করে। ফলে স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝূকি বেড়ে যায়।দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।মানষিক অবসাধ তৈরী হয়; স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। ভবিষ্যত স্মৃতিভ্রষ্টতার (ডিমেনসিয়া) ঝূকি বেড়ে যায়।ডিএনএ লেভেলে পূণর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যহত হওয়ায় ক্যান্সারের ঝূকিও বেড়ে যায়।
এত যে প্রয়োজনীয় ঘুম সেটিও বর্তমান নগরায়নের যুগে বিপন্ন। বৈদ্যুতিক বাতি বা কৃত্রিম আলো আবিস্কারের পুর্বে মানবজাতীর দেহঘড়ি দিনে কাজ রাতে ঘুম অর্থাৎ সার্কাডিয়াম হৃদম মেনেই অভ্যস্ত ছিল।কৃত্রিম আলোর পরে নগরায়নে গতি পায় এবং তখন থেকেই শুরু হয় সার্কাডিয়াম হৃদমের ক্ষয়িষ্ঞুতা।কৃত্রিম আলোর প্রভাবে মানুষ তার কর্মপরিধিকে রাতের সময়ে বিস্তৃত করতে শুরু করে।বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ায় মানেুষের জীবন যাপন পদ্বতিতেও নেমে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন মানুষ তার কর্মব্যস্ততায় ঘরির সময়ের সাথে চলতে শুরু করেছে। অনেক সার্ভিস যেমন হাসপাতাল,সংবাদমাধ্যম, ট্রান্সপোর্ট বা পরিবহন ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ষ্টেশন বা এয়ারপোর্ট ইত্যাদি ২৪ ঘন্টাই চলমান।গ্লোবাল কানেক্টিভিটির যূগে অনলাইনে অনেক কাজকর্ম, ভার্চোয়াল মিটিং চ্যাট ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে রাতের অংশকে কর্মপরিধি দিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে। পড়াশুনা বা উন্নত জীবন যাপন বা চাকুরীর প্রয়োজনে বিপুল সংখ্যক নারীপুরুষ মাইগ্রেশন করছে প্রতিবছর।এদের অনেকেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল দুরত্বে মাইগ্রেশন করছে। প্রিয়জনদের সাথে চ্যাটিং বা কুশলাধি বিনিময়ে এদের অন্তত এক পক্ষ রাতের সময়টিকেই বেছে নিচ্ছে।দিনের চেয়ে রাতের অনেকটা সময় এখন সামাজিক মাধ্যমে আটকে থাকে বিশাল এক জনগোষ্ঠী।কাজের সিফ্টমেন্টের জন্যও অনেকেই রাতের ঘূম দিনে নিতে বাধ্য হন।পৃথিবীব্যাপি এই যে ঘুমের সামাজিকীকরণ চলছে অর্থাৎ রাতে ঘুমের সময়টি কাজে পরিবেষ্টিত হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে রাতের অন্ধকার থেকে ঘুমের একধরণের দূরত্ব তৈরী হচ্ছে তাতে সারকাডিয়াম হৃদমের সমুহ ব্যত্তয় ঘটছে।ফলে দৈহিক এবং মানষিক স্বাস্থের জন্য মারাত্বক ঝূকি তৈরী হচ্ছে।
সারকাডিয়াম হৃদম বা দেহঘড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় প্রধান কারণগুলির মধ্যে রাতের শিফ্টে কাজ করা; ইচ্ছাকৃত রাতজাগা, সামাজিক মাধ্যমে অহেতুক রাত জেগে সময় ব্যয় করা, জেটলেগ বা দীর্ঘ বিমানভ্রমন, অসুস্থতাজনিত ঘুমের সমস্যা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। সারকাডিয়াম হৃদম বা দেহঘরির স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে হলে কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। দিনের আলোর সংস্পর্শে থাকা; ঘুমের সময়ের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল হওয়া; সন্ধার আগে বা পরে স্বল্প সময়ের জন্য ঘুমানো বা ন্যাপ না নেওয়া; হালকা ঘুম নিতে হলে সেটি দুপুরের সাথে সাথে নেওয়া ভালো; রাতে কফি পরিহার করা; দিনে একটু শারীরিক ব্যায়াম করা সারকাডিয়াম হৃদমের জন্য খুবই উপকারী।
অনেকেই মনে করেন রাতে সময় না পেলেও অথবা রাত জেগে পড়াশুনা ব কাজ করলেও দিনের বেলায় ঘুমের সময় পুষিয়ে নেন। তাতে কি আশা করা যায় সারকাডিয়াম হৃদম বা দেহঘড়ির ক্ষতিসাধন হবে না? আসলে দীর্ঘদিন যাবৎ যারা রাতের শিফ্টে কাজ করে দিনের বেলায় ঘুমাতে অভ্যস্থ তাদের বেলায়ও দেহঘরি বা সারকাডিয়াম হৃদমের গুণাবলীর তেমন একটা পরিবর্তন বা সম্পূর্ণরুপে নতুন করে এডজাষ্টমেন্ট হয় না। অর্থাৎ রাতে জেগে থাকার কুফল থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। বর্তমান বৈশ্মিক উষ্ঞায়ণের যুগে পরিবেশ যেভাবে বিপরযয়ের সম্মুখীন সেখানে দেহঘড়িকে সচল রাখতে এবং নিজেকে কিছুটা নিরাপদ রাখতে ঘুমের ব্যাপারে অবশ্যই যত্নশীল হতে হবে। বৈশ্বিক আবহের বিপরীতে হয়তো জীবনের গতি ধরে রাখা সম্ভব নয় তবে যেখানে সূযোগ আছে নিজের প্রয়োজনে নিজের ভালো মন্দের দায় নিজেকেই নিতে হবে। ঘুমের সামাজিকীকরনে গাঁ না ভাসিয়ে চেষ্টা করতে হবে যেকোন মূল্যে সঠিক সময়ে পরিমানমত ঘুম নিশ্চিত করা।একজন কর্মজীবি বা ছাত্র তার দৈনিক ৭-৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। ব্যক্তি বিশেষে এর কিছুটা কম বেশ হতে পারে।ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘুম বা ছোট ছোট স্পেলের চেয়ে টানা বা লম্বা ঘুম অধিকতর ফলপ্রসু।দিনের ঘুম রাতের ঘুমের বিকল্প নয়।
ডা. মো. ছায়েদুল হক:
চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন
এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক
Mail: sayedul.hq@gmail.com