কৃষিপণ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন

 প্রকাশ: ০৭ অগাস্ট ২০২১, ০৩:১৬ অপরাহ্ন   |   অর্থ ও বাণিজ্য


করোনাকাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কৃষি, কৃষক ও ফসলের গুরুত্ব কত বেশি। সুতরাং, এ খাতকে পুঁজিবাদের আগ্রাসী থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে। কৃষিবান্ধব সরকারের সব পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার সফল ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নে সব অংশীজনকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে জড়িত সব পক্ষের মধ্যে কৃষক শ্রম ও সময় দেয় সবচেয়ে বেশি। যদিও এসব পণ্যের মুনাফায় ভাগ সবচেয়ে কম থাকে সে কৃষকেরই। প্রচলিত উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় মুনাফার সিংহভাগই পকেটস্থ হচ্ছে ফড়িয়া থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের। ভোক্তাদের হাতে কৃষিপণ্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের (কৃষক থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা) মোট মুনাফার ২০ শতাংশও কৃষক পান না। ৮০ শতাংশেরও বেশি মুনাফা চলে যায় ফড়িয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে।

মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি খেয়াল রাখার পাশাপাশি খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সরকার কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষি হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই যেন খাদ্যসংকট না হয়, সে জন্য এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষককে সুবিধা দিতে নতুন অর্থবছরে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। 

কৃষিজমির দাম ও ইজারামূল্য বাড়ছে। বর্গা মূল্য ও সেচের মূল্য বাড়ছে। বীজের মূল্য ও সার-কীটনাশকের দাম বাড়ছে। মজুরির দামও বাড়ছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। শুধু কৃষকের ধানের দাম কমছে। বাংলাদেশে অন্যান্য পণ্য যে হারে দাম বেড়েছে, সে হারে কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি। শহরে বাড়লেও কৃষক পর্যায়ে সে দর পান না।খুচরা ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, রাইসমিলওয়ালা, পথে পথে ফড়িয়া ব্যাপারীরা মাত্রাতিরিক্ত লাভ করেন। ট্রাকওয়ালা বেশি ভাড়া নেন, পথে পথে চাঁদা দিতে হয়, গুদামমালিক ভাড়া বেশি নেন। চালের দাম বাড়িয়ে দিলেও শ্রমিক, মজুর, রিকশাওয়ালা নিম্নমধ্যবিত্ত চাল কিনতে পারবেন না। এ কারণেই সরকার চালের মূল্য কমাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। যেমন প্রণোদনা দিচ্ছে, সারের দামে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেচে ভর্তুকি দিচ্ছে, কৃষিঋণ দিচ্ছে, এমনকি কৃষিযন্ত্র ক্রয়েও শুল্ক মওকুফ করছে। 
 সরকারের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হয় সঠিকভাবে, যাতে বরাদ্দগুলো যথাযথভাবে পৌঁছায় প্রকৃত কৃষকের হাতে। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী যেন এসবের ভাগ না পায়। দুধের সরের মতো ওপর থেকে সরটা যেন কেউ খেয়ে না ফেলে। সরবরাহ চেইনগুলো সুষ্ঠু ও সুন্দর করার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে, মেকানিজম বের করতে হবে। কৃষকদের মূলধনসংকট দূর করার জন্য কৃষিঋণ যেন প্রান্তিক কৃষকের হাতেই পৌঁছায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।  সেচে, সারে ও কৃষিযন্ত্র আমদানিতে ভর্তুকির সুফল যেন প্রান্তিক কৃষকেরা পান, সে জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে কার্যকর পন্থা নিতে হবে।
উৎপাদিত এসব কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে অবশ্যই বিভিন্ন পর্যায়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন। তবে এসব ব্যবসায়ী কী মাত্রায় মুনাফা করবেন, সে বিষয়ে কোনো তদারকি বা নিয়ম-নীতি নেই। বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৩২ টাকা দরে বিক্রি হলে তাতে বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের মোট মুনাফা থাকে ১৯ টাকা। এর মধ্যে কৃষকের লাভ থাকে ৩ টাকা ৭২ পয়সা। অর্থাৎ কৃষিপণ্যটির সরবরাহ চেইনের মোট মুনাফায় কৃষকের ভাগ মাত্র ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।  বেগুনের মতো আলুতেও মুনাফার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।কিন্তু এতে  কৃষকের ভাগ ২২ শতাংশেরও কম। টমেটোর ক্ষেত্রে এ হার মোটে ১৩ শতাংশ। এতে উৎপাদক যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ঠকছেন দেশের ভোক্তারা। কভিডকালে সেই প্রবণতা আরো বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কৃষক ও ভোক্তার দামের দূরত্ব আরো বাড়ছে।  স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হলেও এ বাড়তি মূল্যের কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না কৃষকরা। অতিরিক্ত মূল্যের পুরোটাই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।

সরবরাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে দুর্বল অংশীদার হলেন কৃষক। ফলে তাদের কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সে বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনে আরো দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং কৃষকের মজুদক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহ করতে হবে। পণ্য বাজারজাতে পরিবহন সুবিধা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিশ্চিত করা গেলে মুনাফায় কৃষকের ভাগ বাড়ানো সম্ভব হবে।