কালো টাকা সমীক্ষা এবং কর্মসংস্থানে তার সদ্ব্যবহার

মুঃ আবদুল হাকিম
সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বেকার যুবকগণ সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার অধিকারী। প্রাপ্যতার তালিকায় তাদের নামটা সবার আগে।রাষ্ট্রকে ২০(১) অনুচ্ছেদে কর্মসংস্থান এবং২০(২) অনুচ্ছেদে কালো টাকা উচ্ছেদের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে । ২০(২)অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে যাতে কেউ অনুপার্জিত অর্থভোগ করতে না পারে।এ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা খাতে এক লক্ষ সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার মধ্যে বেকার ভাতা নেই। কালো টাকা সনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআন্ড এ জি অফিস এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন নামে ১৯৪৭ সন থেকে ৭৫ বছর ধরে কাজ করছে।তথাপি কালো টাকা উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। আগামিতে হবে এমন আশার আলো দৃশ্যমান নয়। কালো টাকার উৎস দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অপরাধ এবংচাঁদাবাজি। কালো টাকা দেশে থাকলে জনগণ কিছুটা হলেও লাভবান হয়।কিন্ত বিদেশে পাচার হলে দেশ জনগণ চিরতরে ক্ষতিগ্রস্তহয়। সাধারণতঃ ওভার ইনভয়েসিং , আন্ডার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়। পাচার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ববোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের করার আর কিছুই থাকে না।অথচ কালো টাকা দেশে বিনিয়োগ হলে এসব প্রতিষ্ঠা্ন শত শত আইনগত বাধা আরোপ করে।ব্যবসাকে সহজ করতে হলে এসব ঔপনিবেশিক আইন সংস্কার অপরিহার্য।সাদা কালো যাই হোক যারা শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পকারখানা করতে চায় তাদের তা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে করতে দেয়া উচিৎ। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এর ভুরি ভুরি নজির আছে।কাজেই কালো টাকা দেশের শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার একটি আইনসংগত মাষ্টারপ্ল্যান এখন সময়ের দাবি।
দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। খুব একটা সাড়া মেলেনি। মাত্র ২/৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়েছে । প্রশ্ন হলো সুযোগ দিয়ে লাভ কি? কেনই বা কালো টাকার মালিকগণ এই সুযোগ গ্রহণ করছে না ? অনেক কারণ আছে। দেখা যাক কারণগুলো কি? কালো টাকাওয়ালারা জানে সরকারের উপর কালো টাকা সনাক্ত করার জন্য জনগণের তরফ থেকে প্রবল কোনো চাপ নেই। কালো টাকা কার হাতে কোথায় আছে তা সনাক্ত করা কি অসম্ভব? কঠিন বটে। তবে অসম্ভব নয়। কালো টাকা উদ্ধারে জনমত গঠনের ইচ্ছেটা গণমাধ্যমে তীব্র বা প্রবল নয় ।এই সবের গভীরে যাওয়ার কোন তীব্র আগ্রহ মিডিয়ার মধ্যেও নেই। এই কালো টাকা উদ্ধারে লাভ ক্ষতি সম্পর্কে জনগণ উদাসীন। দেশে বেকার সমাজ অসংগঠিত। কালো টাকা উদ্ধার হলে সবচেয়ে লাভবান হবে বেকার সমাজ। তারা হাতে নাতে কিভাবে লাভবান হবে সে ব্যাপারে সুষ্পষ্ট রুপরেখা কেউ তুলে ধরে না। জ্ঞানীগুণীরাও কলামে ২/১ পাতা লিখতে বা টকশোতে ২/৪ টা কথা বলতেই ক্লান্ত। এটা ফলো আপ করা এবং এর গভীরে যাওযার খুব একটা আগ্রহ কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগে কালো টাকার বিকল্প নেই। ব্যাপক দেশী বিনিয়োগ ছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান অসম্ভব। অবিলম্বে গ্রাম থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কালো টাকা উদ্ধারে জনমত গঠন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। উদ্ধার কমিটিগুলো আর কিছুনা করে যদি শুধু সভা করে জনমত গঠন করে তাতেও কালো টাকা জনগণের চোখে অনেকটা দৃশ্যমান হবে। কালো টাকওয়ালারা অন্ততঃ ধরা পড়ার একটা অদৃশ্য ভয় করবে। সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সরকারী কর্মচারী, রাজনীতিবিদগণ নড়াচড়া শুরু করবে।কালো টাকাওয়ালারা নড়ানড়ি শুরু করবে। কালো টাকা গরীব মিস্কিন বা ফকিরের হাতে নেই। আছে ধনীদের হাতে। কাজেই দেশব্যাপী ধনী শুমারি কার্যক্রম শুরু করলে কালো টাকাওয়ালারা কালো টাকা সাদা করার গরজ অনুভব করতে পারে।তখন শিল্প কারখানা করার কঠোর শর্তে সরকার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কালো টাকা সাদা করতে পারে। ডিসিপ্লিন্ড ফোর্স ছাড়া অর্থাৎ আর্মি, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার ছাড়া সকল সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের কালো টাকা উদ্ধারের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। কিভাবে সে ব্যাপারে পর্যায়ক্রমে সরকার নির্দেশ দিতে পারে। তবে প্রাথমিক কাজ হবে যথাশীঘ্র এই ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত একটা করে কমিটি গঠন করে দেওয়া। এইসব করলে কালো টাকা উদ্ধারে জনগণের মধ্যে আগ্রহ ও সচেতনতা সৃষ্টি হবে। মানুষের মনের ফোকাস এদিকে পড়বে এবং একটা পন্থা বের হবে।
প্রতিবারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এটুকুই। কালো টাকা সাদা না করলে কি শাস্তি হবে তা উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় না।যারা সুযোগ গ্রহণ করছে না তারা তানা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। বরং যারা সুযোগ গ্রহণ করছে তাদেরকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হচ্ছে। তাদেরকে নিয়েই টানাটানি। ঝুট ঝামেলা তাদেরই হচ্ছে। তারা সমাজে হেয় হচ্ছে। যারা গোপনে থাকছে তারা সামাজিক মর্যাদা ভোগ করছে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। যাদের কালো টাকা আছে তারা কেউ চুনোপুটি নয়। তারা কেউকেটা। সমাজের হোমরা-চোমরা ব্যক্তি। এক সরকার সুযোগ দিলে আরেক সরকার এসে ঝামেলা বাধায়। এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত এদেশে আছে। এদেশের মানুষের মনো প্রকৃতি হল সামনে দিয়ে সুঁচ পাশাতে দিবনা। পিছন দিয়ে ফাল নিয়ে যাও। এদেশের কিছু মানুষের নৈতিক উন্মাদনাও দুর্নীতিকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করছে। গভীর গবেষণার অভাবে পরিষ্কার হয়ে ব্যাপার গুলো জাতির কাছে ধরা পড়ছে না। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হীনমন্যতা সমস্যাগুলোকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। যারা টাকা সাদা করছে না তাদের কোন ঝামেলা হচ্ছে না।আমাদের দেশের অনেক মানুষ এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেনা। অনেকে চিন্তা করে বিপাকে পড়ারআশ্ংকায় চিন্তা করার অভ্যাসটাই বদলে ফেলেছে।
কালো টাকাগুলো শহরভিত্তিক। যদি একশত শহরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সমীক্ষা পরিচালনা করা যায় তাহলে অনেক পথ ও পন্থা বের হয়ে যাবে। এসব কাজ শুরু করলে খুব চমৎকার ভাবে সম্পন্ন হবে। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালি এক অনন্য এবং অসাধারণ জাতি। শিক্ষিত বেকার দিয়ে আমরা এ কাজটি শুরু করতে পারি।শিক্ষিত যুবকদের পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে আমরা রাষ্ট্রের বিশাল এবং নির্ভুল তথ্য ভান্ডার অনায়াসে গড়ে তুলতে পারি। তাদের ব্যবহার করে আমরা সম্পদ শুমারি এবং প্রচুর সমাজ গবেষণা করতে পারি । এতে করে শিক্ষিত বেকারগণ একটা পার্ট টাইম জব পেতে পারে। অন্যদিকে জাতির এক মহান দায়িত্ব তাদের দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে। এই সমীক্ষার বড় বাধা সম্পদের গোপনীয়তা আইন। মানুষ সম্পদ অর্জন করবে এটা খুব স্বাভাবিক এবং তা কোন পাপ বা দুর্নীতি নয়। তাহলে সম্পদের তথ্য গোপন রাখতে হবে কেনো? সম্পদের তথ্য গোপন থাকার কারণে জাতি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমীক্ষা চালিয়ে কে কত টাকার মালিক তা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এটা খুব জরুরি বিষয় । এটা আমাদের জানতেই হবে যে কে কত টাকার মালিক। এই কাজটা করতে পারলে বর্তমানে যেমন আমরা লাভবান হব তেমনি ভবিষ্যতে দুর্নীতি রোধে এটা হবে একটা মাইলফলক। এটা আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বর আইটেম হওয়া উচিত।
কালো টাকার ধর্ম হল সে বিদেশে পাচার হতে চায় অথবা বিদেশী বিলাস বহুল পণ্য কিনে ধন্য হতে চায়। কালো টাকা পণ্য কেনার হিড়িক তুলে। পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে।অথচ এই কালোটাকা যদি সঠিক উদ্যোক্তার হাতে পড়তো তাহলে সে পণ্য না কিনে মানুষের শ্রম কিনতো। ফলে শ্রমের মূল্য বাড়তো এবং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হতো। কর্মসংস্থানের সাথে মানুষের জীবিকা বা রিজিক সংশ্লিষ্ট। কাজেই এ সমস্যাটি হাল্কা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
কালো টাকা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাড়তি বিপণন সুবিধা দান করে। কষ্টার্জিত অর্থ খরচ হয় কম। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ খরচ হতে চায় বেশি। কালো টাকা শহরে জমি ক্রয়, অট্টালিকা নির্মাণ, হাই রাইজ বিল্ডিং নির্মাণ, শপিং মল নির্মাণ, অশ্লীল ছবি নির্মাণ, অপরাধ বাণিজ্যে বিনিয়োগ, মাদক ব্যবসায় বিনিয়োগ, দেহ ব্যবসায় বিনিয়োগ, অস্ত্র চোরা কারবারিতে বিনিয়োগ এবং কালো বাজারে বিনিয়োগ বেশি হয়। ভালো খবর হল বর্তমানে এটা প্রাইভেট ব্যাংকিংয়েও বিনিয়োগ হচ্ছে। আরো ভালো খবর হল বিদেশে পাচারকৃত কালোটাকা সাদা হয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে দেশেও ফিরে আসছে। খবরটা ভালো বলছি এজন্য যে এতে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সুশাসনের মাত্রা যত বাড়বে সমাজে কালো টাকার আনাগোনা তত কমবে।কালো টাকা অন্ধকার পছন্দ করে। আলো তার অসহ্য। কালো টাকা আলোতে এলে অটোমেটিক্যালি সাদা হয়ে যায়। কালো টাকা দেশি শিল্পে বিনিয়োগ হলে প্রযুক্তি চর্চা ও কর্মসংস্থানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। বেকার সমস্যার সমাধান হবে। সমাজে বহুমাত্রিক সুফল বয়ে আনবে। কালো টাকা ও সাদা টাকার ক্রয় ক্ষমতা সমান। কালো ও সাদা ভেদে এর ক্রয় ক্ষমতার কোন হেরফের হয়না। কোন শপিংমলে এই জাতীয় কোন বিজ্ঞাপন নেই যে এখানে কালো টাকায় কিছু বিক্রয় করা হয় না। কোন উকিল তার মক্কেলকে বলবেনা যে তাকে যেন কালো টাকায় ফি দেওয়া না হয়। কালো টাকায় আমদানি হয় খুব বেশি।
নীতিবাদীরা কালো টাকা সাদা করার এত ঘোর বিরোধী কেন? কারণ কালো টাকা নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকাশ, প্রচারণা এবং গবেষণা খুব কম । সাদা মাথা কালো টাকা নিয়ে খুব কম চিন্তা করে। আমাদেরদেশেগোপনেপ্রচুর কালো টাকার বিনিয়োগ আছে। ভালো মানুষেরা কালো টাকাকে যতই অপছন্দ করুক তাদের অপছন্দ কালো টাকার বহুমাত্রিক বিষক্রিয়াকে কিছুমাত্র খর্ব করতে পারবেনা।
কালোটাকা দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ও বাণিজ্যকে কলুষিতকরে ।অর্থনীতিতেকালোটাকাবেশিহলেহালালরুজিতালাশঅসম্ভবহয়েযায়।কালো টাকাকে আলোতে আনতে দিলে অনেক মহৎ কাজ বা ব্যাপক সংস্কার এদেশে হবে । দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এদেশে কিছু কিছু নীতিবাদী আছে যারা ভাবেরজগতেরমানুষএবং বই পড়া কুতুব। কিছু কিছু নীতিবাদী আছে যারা মোনাফেক এবং জ্ঞানপাপী। আবার কিছু কিছু নীতিবাদী আছে যারা মূলত নৈতিক উন্মাদ। নৈতিক উম্মত্ততার জন্য এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণকে নীতির কাছে বলিদান করে। বাংলাদেশের বহু ভাল কাজ এই সকল নৈতিক উন্মাদের কারণে পন্ড হয়ে গেছে।এদেশ নিয়ে গবেষণা করার কেউ নেই। কারণ গবেষণা করতেও টাকা লাগবে। নীতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়িও একটা নোংরা দুর্নীতি। মানুষের সৃজনশীলতা, উৎপাদনশীলতা ও মানব কল্যাণের প্রতি তা এক ধরণের অপমান।আমাদের দেশের মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জানতে দেয়া হয়না। এ দেশে সরকারি অথবা বেসরকারি পর্যায়ে কখনো ধনী শুমারি বা ধনী গবেষণা হয় না। এদেশের মানুষ অনেক গৌণ বিষয় নিয়ে বেহুদা বিতর্ক করে। অথচ অনেক মুখ্য বিষয়ে তারা খুবই নিলিপ্ত এবং নির্বিকার।নন ইকনোমিক বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মিডিয়া সব সময় একটা হুজুগী সাংবাদিকতায় লিপ্ত। অবশ্য এটা আমাদের মধ্যবিত্ত সাংবাদিক ভাইদের দোষ নয়। জীবিকার তাগিদে মিডিয়ার মালিকদের ব্যবসায়িক ইচ্ছে পূরণ করার জন্য তারকাদের পিছনে ক্যামেরা নিয়ে তাদের দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।অথচ তাদের এই কঠোর পরিশ্রম জাতির অর্থনৈতিক অবস্থা বদলাতে কোন ভূমিকাই পালন করে না। দরকার সুগভীর অর্থনৈতিক রিপোর্টিং।আমেরিকায় কার কত টাকা আছে তার খোঁজ আমরা রাখি ।ফোর্বস ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। অথচ আমাদের দেশে কার কত টাকা আছে তা দেশবাসী জানতে পারে না।
জাতীয় ও মিডিয়া নির্লিপ্ততার জন্য আমাদের ধনীরা পৃথিবীর সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। তারা একে তো অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করছে, অথচ তারা তাদের আয়কর দিচ্ছে না। বছরের পর বছর কর না দিয়ে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের ধরবার নেই। একদলের সরকার সুযোগ দিলে আরেক দলের সরকার এসে তা ধরতে পারে এই ভয়ে তারা কর দেয় না।তারা ভাবে জেনে গেলে কালো টাকা ওয়ালা বলে সমাজ ঘৃণা করতে পারে। পুলিশ ঝামেলা করতে পারে। বেশি আয়ের কথা জানলে সরকার বেশি বেশি চাপ দিতে পারে। সন্ত্রাসীরা চাঁদা পুনঃনির্ধারণ করতে পারে বর্ধিত হারে। কালো টাকার খবর প্রকাশ পেলে বহুবিধ ঝামেলার আশংকা আছে। এমনকি পার্লামেন্টে এই নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হতে পারে। তাদের নিয়ে পত্রিকার কলামের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। টকশোতে তাদের নিয়েমুখরোচক আলোচনা হতে পারে। বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা খর্ব হতে পারে। অনেকে নৈতিক পদস্খলনের জন্য দুর্নীতি করে। অনেকে পরিস্থিতির চাপে করতে বাধ্য হয়। বিচিত্র হল এদেশের মানুষ দুর্নীতি করতে যেমন আনন্দ পায়, দুর্নীতির তীব্র সমালোচনা করেও এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বিষয়ে অশালীনভাবে নিন্দা মুখর। যা নিছক গীবত। কারণ এই সমালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজকে ভালোর দিকে আনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকে না। গোপনে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন অথচ প্রকাশ্যে তারা তার বিরুদ্ধে বেজায় আগুয়ান । কাজের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক হতে আমাদের চরম অনীহা ও অনাগ্রহ। অথচ লাইন ধরে দেশ প্রেমিক সাজতে আমাদের জুড়ি নেই। প্রতিদিনের পত্রিকা কিনে আমরা যে খবর পাচ্ছি এবং টেলিভিশনে আমরা যে খবর দেখছি সারাদিন সেগুলো নিয়ে জাবর কাটছি। এতে করে জনগণের মনোজগতে ক্ষতিকর ঘৃণাএবংউন্মাদনা তৈরি হচ্ছে। মিডিয়ার মাধ্যমে এদেশের বহু জনগণ বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যের প্রচার এবং উক্তি খাচ্ছে। মনোখাদ্য হিসেবে। প্রতিদিন একই জিনিস দেখে দেখে জনগণের মধ্যে একটা বিশেষ ধরনের মনস্তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রচা্রের একটা মনস্তাত্ত্বিক বাজার তৈরি হয়ে গেছে। মনোজগতিক দাসত্ব ধীরে ধীরে আরও শক্ত হচ্ছে। নিজেরা নিজেদের জীবনকে যত উন্নত করছি ততোই বিদেশী চিন্তা প্রীতি এবং পণ্য প্রীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ১৯৪৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৭৫ বছরে কারা কিভাবে কত টাকার মালিক হলো তা গবেষণা করে বের করা খুব জরুরি বিষয়। কেননা দেশে শর্টকাট উপায়ে ধনী হওয়ার সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আয় বৈষম্য দৃষ্টিকটুভাবে বাড়ছে।
কর আদায় রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। বিসিএস(কর) এবং বিসিএস(শুল্ক) কর্মকর্তাদের বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারের সাথে একীভূত করা হলে কাজটি আরো বেগবান হবে বলে আশা করা যায়। আয় গোপন রাখার যৌক্তিকতা কি? নেতিবাচক দিক হল বেশি আয়ের কথা প্রকাশ পেলে ডাকাত বা ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে হবে। বেশি আয় হলে মানুষ ও সমাজ প্রশ্ন তুলবে। দুর্নীতি পরায়ণ হিসেবে চিহ্নিত হবার আশংকা থেকে যায়। প্রতিবেশী হিংসে করবে। বেশি আয়ের কথা জানলে ভিক্ষুক বেড়ে যাবে। চাঁদাবাজদের উৎপাত বেড়ে যাবে। সন্ত্রাসীদের মোটা অংকের চাঁদা দিতে হবে। ইতিবাচক দিক হল আয় জানলে মানুষ আয় অনুপাতে মর্যাদা দিবে।কালো টাকা দেশে বিনিয়োগ হলে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গৃহীত না হলেও সরকার সঠিক ভাবে আয় কর নির্ধারণ করতে পারবে। কালো টাকা শনাক্ত করা সহজ হবে। রাজস্ব বাড়বে। বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হবে। দীর্ঘ মেয়াদী বেকার সমস্যার কারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুলো কাজ করছেনা। নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেউ কারো কথা শুনছে না। বেকার সমস্যা নিয়ে অনেক বলাবলি করা হচ্ছে কিন্তু বেকার সমস্যার কোন সমাধান বের করা হচ্ছে না। সমাজে সমস্যাজীবি একটা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যাকে পুঁজি করে এরা নিয়োগ বাণিজ্যের ধান্দা করে এবং সমস্যা সমাধানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। একটা রোগের দীর্ঘদিন চিকিৎসা না হলে অন্য আরো অনেক রোগের সৃষ্টি হয়। সমস্যার সমাধান না হলে অনেক নতুন নতুন সমাজ সমস্যা সৃষ্টি হয়।
সমাজে ভালো লোক কারা এটা জানা খুবই জরুরি। সমাজের সব লোক ভালো নয়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভালো। তাই ভালো লোকের তালিকা কিভাবে করা যায় তা খুঁজে বের করা দরকার। ভালো লোক হান্টিংকরা, ভালো লোক অনুসন্ধান করা এবং ভালো লোক গুলোকে ফোকাস করা মিডিয়ার দায়িত্ব। মতামতের ভিন্নতা এমন এক জটিল মতানৈক্যের সৃষ্টি করছে যা সমাজ ও জাতিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত করছে। ভাল মানুষগুলোকে কালো টাকা উদ্ধারের সামাজিক আন্দোলনে এবং জনমত গঠন কমিটিতে সম্পৃক্ত করে দেশব্যাপী একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক গঠন করা যেতে পারে।
লো বাজেট সরকার খুব বড় কোন সমাজ বিপ্লব ঘটাতে পারবে না। বড় বিপ্লব ঘটাতে গেলে একটা বিগ বাজেট সরকার দরকার। কালো টাকা বাদ দিয়ে বিগ বাজেট সম্ভব নয়। কাজেই আভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ আগামী বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত । আভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের গতিবেগ বাড়ানোর জন্য কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করতে পারে।