বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার এখনই সময়: পাকিস্তানের কেন এটা অনুধাবন করা উচিত?

 প্রকাশ: ১৫ অগাস্ট ২০২১, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন   |   মিডিয়া কর্নার


পথিক হাসান: 
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ নামে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সম্পূর্ন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারপরে দীর্ঘ ৫০ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ও গ্রহনযোগ্যতা পৃথিবীর প্রত্যেকটা রাষ্ট্রের কাছে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের প্রশংসা সারা বিশ্বের সবাই মেনে নিচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার উদীয়মান তারকা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বাংলাদেশ আজকে এতটা উন্নতি করছে মে খোদ পাকিস্তানের এক অর্থনীতিবিদ ড. আবিদ হাসান পাকিস্তানের এক পত্রিকা দি নিউজ ইন্টারন্যাশনালে এক নিবন্ধে বলেছেন মে, পাকিস্তান ২০৩০ সালের দিকে বাংলাদেশের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ ঠিকই ভবিষ্যত বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশ যদি শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ দিতে পারে, সোমালিয়া ও সুদানের কাছে পাওয়া আইএমএফ এর বাংলাদেশের অংশের টাকা মওকুফ করে দিতে পারে, ইন্দোনেশিয়াকে কোভিড-১৯ মেডিকেল সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করতে পারে, মিয়ানমারের বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা কে আশ্রয় দিতে পারে, তবে অবশ্যই পাকিস্তানেও আর্থিক সাহায্য দিতে পারবে। এই জন্য পাকিস্তানের মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যক। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটা মানবিক রাট্র। 
কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব হল তাঁর বৈদিশিক  নীতি। যে  বাংলাদেশ কে ২৪ বছর শোষণ করেছিল, সেই পাকিস্তান আজকে অনেক আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্র পিছিয়ে আছে। পাকিস্তানের এক সাংবাদিক এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মত বানিয়ে দিতে বলেছিলেন। সম্প্রতি কানাড়া ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস এন্ড সিকিউরিটি  নামে একটা থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে। সেখানে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ সূচকের সবক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। ভারতের অনেক অর্থনীতিবিদ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে সবদেশগুলোকে বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করতে বলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হোসেন হাক্কানি বলেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা চালিয়েছিল বাংলাদেশে। তবে পাকিস্তান সরকার গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনোও ইঙ্গিত নেই। তিনি ২০২১ সালের মার্চের শেষের  দিকে  ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত এ মন্তব্য করেন। 
পাকিস্তানের জনগণের উচিত তাদের সরকারকে আহ্বান করা, যাতে তারা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত সব ধরনের নির্যাতনের জন্য ক্ষমা চায়।
পাকিস্তানের আপামর জনগনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে সহানুভূতিশীল। যদিও পাকিস্তান সরকার বিকৃতভাবে পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে এবং বিভিন্ন প্রকাশনায় উপস্থাপন করে। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে জনগণ অনেক সচেতন। আমরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে পাকিস্তানি নাগরিকদের মতামত জানতে পারি। তারাও চায় পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাক ১৯৭১ সালে তাদের পাশবিক কৃতকর্মের জন্য। পাকিস্তান মে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল, পৃথিবীর গনহত্যা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এটা স্বীকার করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে যেভাবে বাঙালিকে হত্যা করেছে এজন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত |আজকে মে সার্থক অচল, তার জন্ম পাকিস্তানকে দায়ী করা হয়। পাকিস্তানের উচিত সবকিছু বুঝে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। তখন এই করোনার মধ্যেও দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশের নেতারাই বাংলাদেশ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছিল মার্চ মাস। কিন্তু পাকিস্তানের কোন নেতা আসে নি। পাকিস্তান শুধু অফিসিয়াল ভাবে একটা শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়েছে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আন্তরিকতার প্রয়োজন ছিল এখানে। আসছে ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ তাঁর বিজয় দিবসের সুবর্নজয়ন্তী পালন করবে। আমি মনে করি পাকিস্তানের জন্য এটা একটা সুবর্ন সুযোগ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে সফরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা চাইতে পারে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ এটা ইতিবাচক ভাবে নেবে কারন বাংলাদেশ ক্ষমা করতে জানে। দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ উঠতি শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের  অনেক সিনিয়র নাগরিক বৃন্দ এই ব্যাপারে পাকিস্তানের সরকারকে চাপ দিতে পারে। সময় এসেছে পাকিস্তান যে গর্হিত কাজ করেছিল তা অনুধাবন করার। পাকিস্তানের এই অতীত কৃতকর্মের বোঝা কেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত বহন করবে এটা পাকিস্তান সরকারের বোঝা উচিত। যদিও ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এই বিষয় নিয়ে প্রচুর কথা বলতেন, কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর একটা বড় ভূমিকা থাকায় ইমরান খান কিছু করতে পারছেন না। তবুও পাকিস্তানের আপামর জনমতকে উপেক্ষা করা সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকার কারোর জন্যই ভালো না। পাকিস্তানের এটা এখনই এটা অনুধাবন করা উচিত। সময় এসেছে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার । কারন ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা ও প্রায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর চিৎকার এখনো শোনা যায়। আমরা আশা করি পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবে। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির সঙ্গে পাকিস্তান যে অন্যায় করেছে সে অন্যায়ের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
পাকিস্তানের সুশীল সমাজের সদস্য গণ, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম, বিদেশে বসবাসকারী প্রবাসী পাকিস্তানী নাগরিক, পাকিস্তানের ভিন্ন মতাবলম্বীরা এটা অনুধাবন করতে পারলেও পাকিস্তানের এলিট ক্ষমতাশালীরা কেন এটা অনুধাবন করতে পারেন সেটাই হল সমস্যা। অন্যায় করার পর কারও কাছে কাছে ক্ষমা চাওয়া মানে ছোট হ ওয়া না, বরং নিজেকে মহৎ ও বিনয়েয় মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রকাশ করা। ফ্রান্স ও জার্মানি যদি এতদিন পর রূয়ান্ডার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে, পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা চাইতে পারবে না। 
ইউরোপের বড় দুই সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি - ফ্রান্স ও জার্মানি যদি এটা করতে পারে তো অন্য কারো এটা করতে সমস্যা হওয়ার কথা না। পাকিস্তানের এটা অনুধাবন করা উচিত। যদিও পাকিস্তান অনেক দেরি করে ফেলেছে, তারপরও সময় একেবারে চলে যায় নাই। যেহেতু ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করেছিল, সেই ১৬ই ডিসম্বরেই পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা চাইতে পারে। তবুও বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাবে। এটা পাকিস্তান সরকারকে অনুধাবন করা উচিত। কারন তাদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাধারন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন। এটা যত তাড়াতাড়ি পাকিস্তান সরকার অনুধাবন করবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে চায় তাহলে পাকিস্তানকে অবশ্যই ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। তখনই কেবল উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। অর্ধশত বছর পর এসে পাকিস্তানিরা তাদের অতীত ভুলে যেতে পারে না। সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাইলে পাকিস্তানকে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। কোনো দেশই তাদের অতীত ভুলে সামনে এগোতে পারে না।


(পথিক হাসান : এনজিও ও সমাজকর্মী, সমসাময়িক আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর লেখক।)

মিডিয়া কর্নার এর আরও খবর: